বরিশাল সদর উপজেলার চর কাউয়া ইউনিয়নের কর্ণকাটি এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী নেতা ও কথিত রাজনৈতিক নেতা মাইনুল ফকির আবারও আলোচনায়। দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি, দেশীয় অস্ত্র ব্যবসা, জমি দখল, খুন, নারী নির্যাতন, মাদক কারবারসহ অসংখ্য অপরাধে জড়িত এই চক্রের বিরুদ্ধে এবার প্রকাশ্যে এক ঠিকাদার ব্যবসায়ীর উপর প্রাণনাশের হুমকি ও নৃশংস হামলার অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৪ আগস্ট ২০২৫ বিকেল পাঁচটার দিকে সাহেবের হাট থানার চৌমাথা বাজার সংলগ্ন তালুকদার মার্কেট এলাকায়।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী সেলিম হাওলাদার বর্তমানে গুরুতর আহত এবং চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ঘটনার বিবরণ: দিনের আলোয় অস্ত্রসজ্জিত হামলা ভুক্তভোগী সেলিম হাওলাদার, যিনি একজন ঠিকাদার ব্যবসায়ী, অভিযোগে উল্লেখ করেছেন-সেদিন বিকেলে মাইনুল ফকির চারজন সশস্ত্র সহযোগীসহ তার দোকানে প্রবেশ করে। তাদের হাতে ছিল ধারালো রামদা, চাপাতি, লোহার রড ও একটি পিস্তলসহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র। প্রথমে তারা ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মাইনুল ফকির নিজ হাতে লোহার রড ও পিস্তলের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে।
সেলিম হাওলাদারের ভাষায়-“ওরা শুধু মারধর করেনি, প্রকাশ্যে পিস্তল বের করে মাথায় ঠেকিয়ে বলেছে, চাঁদা না দিলে গুলি করবে। আমার দোকানে থাকা ক্রেতারা আতঙ্কে ছুটে পালিয়ে যায়। মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যায়। যদি স্থানীয়রা এগিয়ে না আসত, হয়তো আজ বেঁচে থাকতাম না।” তিনি আরও জানান-তার অন্যান্য ব্যবসাও ফ্যাসিবাদী সরকার থাকাকালীন সময়ে মাইনুল ফকিরের বাহিনী দ্বারা বিভিন্নভাবে দখল ও ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখনো সেই অত্যাচার বন্ধ হয়নি, বরং প্রশাসনের নাকের ডগায় আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয়ে তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
অস্ত্রের ভয়াবহ মজুদ ও সরবরাহ নেটওয়ার্ক এলাকাবাসীর দাবি, মাইনুল ফকিরের বাহিনীর কাছে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র মজুদ রয়েছে। এ অস্ত্রগুলো তারা রাতে নৌপথ ব্যবহার করে গ্রামীণ খাল ও নদীপথে বহন করে এবং গোপনে বরিশালসহ আশপাশের জেলায় সরবরাহ করে। তাদের ভাণ্ডারে রয়েছে- ধারালো রামদা ও চাপাতি লোহার রড ও হাতুড়ি দেশীয় তৈরি বন্দুক পিস্তল ও গুলি স্থানীয়রা আরও জানান, বহুবার এই বাহিনীকে প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রা করতে দেখা গেছে।
কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি। রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও রঙ বদলের ইতিহাস মাইনুল ফকির বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগের পুরনো নেতা পরিচয়ে ক্ষমতার সুযোগ নেন। ক্ষমতার ছায়ায় থেকে তিনি একটি বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করেন, যারা জমি দখল, খুন, হত্যাচেষ্টা, নারী নির্যাতন, মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র কারবারের মতো গুরুতর অপরাধে লিপ্ত। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি রাজনৈতিক রঙ বদলে বিএনপি ও অন্যান্য প্রভাবশালী মহলের সাথে যোগ দেন।
রাজনৈতিক অবস্থান বদলালেও অপরাধের ধারা থামেনি; বরং ক্ষমতার ভারসাম্য বদলকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। পূর্বের অপরাধের নজির: হত্যাকাণ্ড থেকে চাঁদাবাজি শুধু বরিশাল নয়, রাজধানী ঢাকাতেও তার প্রভাব বিস্তার রয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকায় বরগুনার এক কৃতি ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও চাঁদা দাবি করেছিল এই চক্র। চাঁদা না দেওয়ায় সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে পাথর মেরে হত্যা করে।
এ ঘটনায় মামলা হলেও মূল হোতা মাইনুল ফকির ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গোপন সূত্রে জানা যায়, মাইনুল ফকিরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ও মামলা রয়েছে, তবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। এলাকায় চরম নিরাপত্তাহীনতা সাহেবের হাট বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, দিনের বেলাতেই দোকানে ঢুকে চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা না দিলে দোকান ভাঙচুর, লুটপাট ও হামলা চালানো হয়।
অনেকেই ভয়ে দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। রাতের বেলা মোটরসাইকেলের শোভাযাত্রা ও গুলির শব্দে পুরো এলাকা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। একজন প্রবীণ ব্যবসায়ী বলেন- “এভাবে চলতে থাকলে সাহেবের হাট বাজার ব্যবসার জায়গা নয়, সন্ত্রাসীদের আড্ডায় পরিণত হবে।” আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া সাহেবের হাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাংবাদিকদের জানান- “আমরা লিখিত অভিযোগ পায়নি। অস্ত্রের বিষয়টিও তদন্ত করা হবে। প্রমাণ পেলে অস্ত্র আইন ও দণ্ডবিধির অধীনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
এলাকাবাসীর দাবি: দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন-অবিলম্বে মাইনুল ফকির ও তার বাহিনীকে গ্রেফতার করতে হবে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও অস্ত্র ব্যবসার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালাতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন সাহস না পায়। তাদের ভাষায়-“আজ যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, কাল হয়তো আমরা কেউ নিরাপদে ঘুমোতে পারব না।”